‘লাল জমিন’ ও মুক্তিযুদ্ধের এক বালিকা

‘লাল জমিন’ ও মুক্তিযুদ্ধের এক বালিকা

কিশোরীর সাদা ধবধবে ‘জমিন’-জীবন নয় মাসে কী করে একটা ‘লাল জমিন’ হয়ে ওঠে- তা নিয়েই এই নাটক। 
 
লাল জমিন নাটকটি মঞ্চে দেখেঁছেন অথচ আবেগে আপ্লুত হননি এমন দর্শক পাওয়া ভার। কেউ কেউ উঁচ্চ স্বরে কেঁদেছেন নাটক চলাকালে। আর নাটক শেষে অভিনেত্রীকে জড়িয়ে ধরে সহমর্মিতা প্রকাশ করেন অনেকেই। যুদ্ধস্মৃতি জাগিয়ে তোলা নাটকে মোমেনা চৌধুরীরর অনবদ্য অভিনয় আবেগাপ্লুত করে তোলে দর্শকদের। 
 
নাটকটি প্রথমবার দেখার সুযোগ হয় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় অডিটেরিয়ামে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসের শুরুর দিকে। এরপর সুযোগ করে আরো একবার দেখেছিলাম জহির রায়হান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে। আমি নিজেও হারিয়ে গিয়েছিলাম সেই ৭১ এ !
 
নাটকের প্রতিটি পরতে পরতে ১৪ বছর বয়সী কিশোরীর জীবনে মুক্তিযুদ্ধের জীবন ফুঁটিয়ে তুলেছেন। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে তাঁর দুরন্ত বালিকাজীবন, বর্ণিল কৈশোর, দুঃসহ বয়ঃসন্ধিকাল ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। মুহূর্তেই এককাল থেকে আরেককালে যাচ্ছেন তিনি, নিয়ে যাচ্ছেন যেন দর্শককেও। মঞ্চই বাড়ির উঠোন, খড় ছিটানো, এক্কাদোক্কা খেলা, ফসল ফলনের জায়গা, পদ্ম-শাপলা ফোটা বিল। দর্শকের সামনে পুরো মঞ্চটাই যেন এক টুকরো বাংলাদেশ ...
 
মুক্তিযুদ্ধে একজন কিশোরীর অংশগ্রহণ, গল্পের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধের ভয়াবহতা, লক্ষ্যে পৌঁছবার আগেই পুরুষ যোদ্ধাদের শহীদ হওয়া, নারী সদস্যদের ওপর নেমে আসা ভয়াবহ নির্যাতন, কিশোরীর ত্যাগ-সবশেষে কিশোরী বিভীষিকাময় এই নারকীয় তান্ডবে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। 
অপরদিকে নাটকের ঠিক মাঝামাঝিতে দেখা যায় খানখান হয়ে ভেঙে পড়া মোমেনার স্বপ্ন। শেষে দেখা যায়, মুক্তিযুদ্ধে পাওয়া বাংলাদেশ যেন লুটেরাদের রাজ্য! অবাধ শোষণ, নির্যাতন, বঞ্চনা আর প্রতারণার অভয়ারণ্য। 
 
সেসময় তার চৌদ্দ বছরের সাদা জমিনে লাল রক্ত ঝরে পড়েছিল দেশের স্বাধীনতার জন্য। পরবর্তীতে দেশ স্বাধীন হয়। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। লাল সবুজের পতাকা। পরবর্তিতে বহু বছর পর প্রশ্ন জাগে কিশোরীর। রাজাকারদের দাপট কেন থামেনি? কেন এত বছর পর বৃদ্ধ বয়সে মরা শরীর নিয়ে লাল পতাকায় ঠাঁয় দাঁড়িয়ে পুরনো ইতিহাস বলতে হয়? কেন আমাকে আবার বিবস্ত্র করা হয়? প্রশ্ন জাগে-কেন ওরা স্বাধীনতা বুঝে না। কেন ওরা দেশ বুঝে না। কেন ওরা পতাকা বুঝে না। প্রশ্ন জাগে মনে এত বছর পরও কেন ওদের মুক্তিযুদ্ধ বুঝাতে হবে।
 
হলভর্তি সব দর্শক স্তম্ভিত হয়ে মোমেনার অভিনয় দেখে, নিশ্চুপ মুগ্ধতায়। প্রায় এক ঘণ্টা পাঁচ মিনিটের নাটকটি মঞ্চায়নের পর তাঁকে জড়িয়ে কেঁদে ফেলেন অনেক দর্শক। লুকিয়ে চোখ মোছেন মঞ্চের অতিথিরাও। জহির রায়হান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে এক রিকশাচালক সারা দিনের কষ্টার্জিত অর্থ তুলে দিয়েছেন কুশীলব মোমেনা চৌধুরীর হাতে।
 
 
পরিচালক মান্নান হীরা দর্শককে নিয়ে যান আরও অনেক গহীনে। তা না হলে কি প্রত্যেক দর্শকের চোখেই অশ্রু ঝরে? একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধে এক নির্যাতিত বালিকার আর্তনাদের কাহিনি ‘লাল জমিন’। 
 
২০১১ সালে শূন্যন রেপার্টরি দল মঞ্চে আনে মান্নান হীরার লেখা নাটক ‘লাল জমিন’, নির্দেশনার দায়িত্ব পান সুদীপ চক্রবর্তী। নাটকে  একক অভিনয় করেন মোমেনা চৌধুরী। এছাড়া মঞ্চায়নের নেপথ্য কারিগররা হলেন- আতিকুল ইসলাম, আতিকুর রহমান, মীর্জা শাকিব, মোসাম্মৎ মমতাজ, জুয়েল মিজি, তানভীর সানি ও নিথর মাহবুব। নাটকটি রচনা করেছেন মান্নান হীরা ও নির্দেশনায় ছিলেন সুদীপ চক্রবর্তী প্রমুখ।

Post a Comment

0 Comments